Header Ads

কান কি? কানের গঠন প্রণালি || শ্রবণ প্রণালি

 মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটি হচ্ছে শ্রবণেন্দ্রিয়। শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রধান এবং একমাত্র অঙ্গ হচ্ছে কর্ণ বা কান। মানুষের মাথায় প্রায় ৭ বা ৮ ইঞ্চি ব্যবধানে কর্ণগুলোর(২টি কর্ণের) অবস্থান। আর এর প্রধান উদ্দিপক হচ্ছে শব্দ। মানুষের জীবন পর্যায়ে কর্ণ বা কানের ভুমিকা অপরিসীম। কানের মাধ্যমেই আমরা পরিবেশের বিভিন্ন শব্দ বিষয়ক ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত হতে পারি।

 

শব্দ আমাদের কর্ণে/কানে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াঃ

আমরা জানি যে, শব্দ কোন মাধ্যম ছাড়া পরিবাহিত হতে পারে না। আমাদের চারপাশের খালি জায়গা/শূন্যস্থান বাতাসে পরিপুর্ণ। এই বাতাসে রয়েছে অসংখ্য অনু-পরমাণু। এ সকল অনু পরমাণু কম্পিত হলেই শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই শব্দ তরঙ্গ দ্বারাই উদ্দীপিত হয় কান। কানের শ্রবণ স্নায়ুর মাধ্যমে এই উদ্দিপনা মস্তিষ্কে পৌঁছালে আমরা শুনতে পাই।

 

কানের বা কর্ণের গঠন এবং কার্যাবলিঃ

মানব কর্ণকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়ঃ

১। বহিঃকর্ণ (External Ear)

২। মধ্যকর্ণ (Middle Ear)

৩। অন্তঃকর্ণ (Inner Ear)

 

বহিঃকর্ণঃ

এটি কানের প্রথম অংশ। এটি আরও তিনটি অংশে বিভক্তঃ

১। কানের পাতা (Pinna)

২। কর্ণ নালি/কণর্   কূহর (Ear Cannel)

৩। কর্ণপটহ (Ear Drum)

কানের পাতা: এটি মাথার দুইপাশে অবস্থিত এবং এটি তরুণাস্থি নির্মিত লোমশ অংশ। এটি দেখতে অনেকটা ফানেল/চোঙ্গা আকৃতির।

কাজ: কানের পাতা শব্দতরঙ্গকে সংগ্রহ ও কেন্দ্রীভূত করে এবং কর্ণনালিতে প্রেরণ করে।

 

কর্ণনালি: কানের পাতা একটি নালী দ্বারা সংযুক্ত থাকে। এ নালীকে কর্ণনালি বলে। এর এক পাশে কানের পাতা (Pinna) এবং অন্য পাশে কর্ণপটহ (Ear Drum)। এই নালীটি কর্ণপটহ এর সাথে তীর্যকভাবে অবস্থান করে। যাতে কণপটহ সহজে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। কর্ণ নালি ২/৩ অংশ তরুণাস্তি এবং  ১/৩ অংশ অস্থি নির্মিত। কর্ণনালি লোমযুক্ত ত্বক ও মোমগ্রন্থি দ্বারা আবৃত থাকে।

কাজ:

১। এর মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গ কানের পর্দায় পৌঁছায়।

২। এর মধ্যে থাকা লোমশ ত্বক ও মোম কানের ভিতরে ধুলোবালি ও জীবাণু প্রবেশে বাধা দেয়।

৩। কানের পর্দার অনুকূল তাপমাত্রা ও আদ্রতা বজায় রাখে।

 

কার্ণপটহ/কানের পর্দা: বহিঃকর্ণ ও মধ্যকর্ণের মধ্যে ডিম্বাকৃতির (Oval Shape) ধূসর সাদা যে পর্দা বিদ্যমান তাকে কর্ণপটহ বলে। এটিকে অনেকে কানের পর্দা ও টিমপ্যানিক পর্দা বলে থাকে। এর সাথে মধ্যকর্ণের অস্থিশৃঙ্খলগুলো সংযুক্ত থাকে। এই পর্দাটির বাইরের দিক অবতল এবং ভিতরের দিক উত্তল।

কাজ:

 ১। শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে কর্ণপটহ স্পন্দিত হয়।

 ২। এটি বহিঃকর্ণকে মধ্যকর্ণকে পৃথক রাখে।

 

মধ্যকর্ণ:

অন্তঃকর্ণ ও বহিকর্ণের মধ্যবর্তী বায়ুপূর্ণ প্রকোষ্ঠকে মধ্যকর্ণ বলে। এটি তিন ভাগে বিভক্ত। যথা:

১। অস্থিশৃঙ্খল (Ossicles)

২। ইউস্টেশিয়ান নালি (Eustachian Tube)

৩। ছিদ্রপথ (Window)

 

অস্থিশৃঙ্খল: কানের পর্দার পিছনে সংযুক্ত তিনটি কর্ণাস্থিকে একত্রে অস্থিশৃঙ্খল বলে। কর্ণাস্থি তিনটি হচ্ছে:

I) ম্যালিয়াস: এই অস্থি দেখতে অনেকটা হাতুরির মতো। এটির একদিক কানের পর্দার সাথে এবং আরেক দিক ইনকাসের সাথে যুক্ত।

II) ইনকাস: এটি কামারের নেহাই এর মতো। এই অস্থিটির একপাশ ম্যালিয়াসের সাথে এবং অন্যপাশ স্টেপিস এর সাথে সংযুক্ত।

III) স্টেপিস: ঘোড়ার খুড়ের মতো দেখতে ত্রিকোনাকার এই অস্থিটির একপাশ ইনকাসের সাথে এবং অপর পাশ ওভাল উইন্ডো এর সাথে সংযুক্ত।

অস্থিসমূহের কাজ: কানের পর্দা থেকে শব্দতরঙ্গ অন্তঃকর্ণের পেরিলিম্পে বহন করে থাকে।

 

ইউস্টেসিয়ান নালি: মধ্যকর্ণ ও নাসিকা সংলগ্ন গলবিলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী নালিকাকে ইউস্টেশিয়ান নালি বলে।

 

কাজ: এ নালি মধ্যকর্ণের মধ্যে বহিঃকর্ণ ও অন্তঃকর্ণের বায়ুচাপের সমতা রক্ষা করে। এজন্য কানের পর্দা ফেটে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়।

 

ছিদ্রপথ: মধ্যকর্ণের শেষ প্রান্তে একটি পর্দা রয়েছে। এ পর্দায় দুটি ছিদ্র রয়েছ্। টি ছিদ্র ডিম্বাকৃতির  আরেকটি গোলাকার। ডিম্বাকৃতির ছিদ্রের নাম ওভাল উইন্ডো বা ফেনেস্ট্রা ওভালিস এবং গোলাকার ছিদ্রের নাম রাউন্ড উইন্ডো বা ফেনেস্ট্রা রোটান্ডা। স্টেপিস অস্থির শেষভাগে ওভাল উইন্ডো সংযুক্ত থাকে। শব্দতরঙ্গ যখন স্টেপিস অস্থিকে আঘাত করে তখন রাউন্ড উইন্ডো স্ফীত হয়।

কাজ:

I) মধ্যকর্ণ থেকে শব্দ তরঙ্গ ওভাল উইন্ডো এর মাধ্যমে অন্তঃকর্ণে বাহিত হয়।

II) শব্দ তরঙ্গ ককলিয়ার প্রবেশের পর কাজ শেষে আবার ওভার উইন্ডো এর মাধ্যমে বাহিরে বেড়িয়ে আসে।

 

অন্তঃকর্ণঃ অন্তঃকর্ণের অবস্থান শ্রুতিকোটরের অভ্যন্তরে। অন্তঃকর্ণের প্রধান অংশ হচ্ছে মেমব্রেনাস। অন্তঃকর্ণ পেরিলিম্প নামক পদার্থে ভাসমান থাকে এবং এতে এন্ডোলিফ নামক তরল পদার্থ থাকে। প্রতিটি কানের অন্তঃকর্ণ দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। যথা:

১) ভেস্টিবুলার যন্ত্র

২) ককলিয়া।

 

ভেস্টিবুলার যন্ত্র: ভেস্টিবুলার যন্ত্র একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী অঙ্গ। এর এক পাশ্বে ককলিয়া এবং অপর পাশ্বে অর্ধবৃত্তাকার জলনালি। এটি অন্তঃকর্ণের উপরের দিকের একটি গোল প্রকোষ্ঠ। এর সাথে একটি আনুভুমিকভাবে এবং দুটি উলম্বভাবে অবস্থিত মোট ৩ টি অর্ধবৃত্তাকার জলনালি থাকে। এই নালিগুলোকে অর্ধবৃত্তাকার নালি বলে। প্রত্যেকটি নালিকার এক প্রান্ত স্ফীত হয়ে অ্যাম্পুলা তৈরি করে যার মধ্যে সংবেদী রোম থাকে। রোমগুলো চুনাময় জেলির মতো অটোলিথে আবৃত থাকে।

 

কাজ: দেহের ভারসাম্য রক্ষা করা।

 

ককলিয়া: ককলিয়া হচ্ছে অন্তঃকর্ণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ককলিয়া দেখতে অনেকটা শামুকের মতো। এটি প্রায় আড়াই প্যাচ বিশিষ্ট নালি। ককলিয়ার মধ্যে রেসলার মেমব্রেন এবং ব্যাসিলার মেমব্রেন নামক দুটি পর্দার্ থাকে। রেসলার মেমব্রেন ও ব্যাসিলার মেমব্রেন ককলিয়াকে তিনটি জলপথে বিভক্ত করে। সেগুলো হল:

I) ককলিয়ার জলপথ

II) ভেস্টিবুলার জলপথ

III) টিমপ্যানিক জলপথ।

 

কানের বিভন্ন অংশ ও তাদের কার্যক্রম:

 

কানের অংশ

অবস্থান

কার্যক্রম

পিনা/কানের পাতা

মাথার দুইপাশে তরুণাস্থি নির্মিত কানের বাইরের প্রসারিত অংশ।

শব্দতরঙ্গ সংগ্রহ,কেন্দ্রীভূতকরণ ও কর্ণকুহরে প্রবেশে সহায়তা করা।

কর্ণকূহর/কর্ণনালি

কানের পাতার কেন্দ্রে থেকে শুরু করে কর্ণপটহ বা কানের পর্দার পর্যন্ত নালিটিকে কর্ণকূহর বলে।

কানের পর্দা পর্যন্ত শব্দতরঙ্গ প্রেরণ।

কানের পর্দা/টিমপ্যানিক পর্দা/কর্ণপটহ

কর্ণনালির শেষ প্রান্তে অবস্থিত বহিঃকর্ণ ও অন্তঃকর্ণের বিভক্তকারী পর্দাকে কানের পর্দা বা টিমপ্যানিক পর্দা বলে।

শব্দ তরঙ্গকে মধ্যকর্ণে প্রেরণ।

কণাস্থি

মধ্যকর্ণে অবস্থিত

শব্দ তরঙ্গকে বহিঃকর্ণ হতে অন্তঃকর্ণে প্রেরণ করে থাকে এই কর্ণাস্থিগুলো।

ককলিয়া 

অন্তঃকর্ণের ভিতরে অবস্থিত শামুকের ন্যায় প্যাচানো অস্থিময় নালিকা বিশেষ।

শ্রবণ উদ্দিপনা গ্রহণ করে এবং সেই উদ্দিপনা মস্তিষ্কে প্রেরণ করে।

অর্গান অব কর্টি/ হেয়ার সেল

ককলিয়ার ব্যাসিলার মেমব্রেনের উপর অবস্থিত এবং শ্রবণ স্নায়ুর সাথে যুক্ত।

শব্দের গ্রাহক যন্ত্র অর্থাৎ রিসিভার রূপে কাজ করে।

ভেস্টিবুলার যন্ত্র

ভেস্টিবুলার যন্ত্রের একপাশে অর্ধবৃত্তাকার জলনালি এবং অপর পাশে ককলিয়া অবস্থিত।

ভারসাম্য রক্ষা করে।

অর্ধবৃত্তাকার জলনালি

অন্তঃকর্ণের মধ্যে অবস্থিত তিনটি পর্দাময় ল্যাবিরিস্থের সমন্বয়ে গঠিত একটি অন্যতম উপাদান।

ভারসাম্য রক্ষা করে।

অটোলিথ

অটোলিথ ভেস্টিবুলার যন্ত্রে বিদ্যমান চুনা সদৃশ এ প্রকার কণিকা বিশেষ।

ভারসাম্য রক্ষা করে।

ইউস্টেশিয়ান নালি   

মধ্যকর্ণ ও নাসিকা সংলগ্ন গলবিলের সংযোগ নালি।

মধ্যকর্ণ ও গলবিলের বায়ুচাপের সমতা বজায় রাখে।

 

শ্রবণ প্রণালিঃ শ্রবণেন্দ্রিয়ের মূল উদ্দিপক হচ্ছে শব্দতরঙ্গ। এই শব্দ তরঙ্গ বহিঃকর্ণের কর্ণনালি/কর্ণকূহরে প্রবেশ করে এবং কানের পর্দাকে আঘাত করে। এ আঘাতের ফলে কানের পর্দাতে স্পন্দনের সৃষ্টি হয়। শব্দ তরঙ্গ যখন কানের পর্দাকে আঘাত করে তখন এর সাথে সংযুক্ত অস্থিশৃঙ্খলসমূহ কম্পিত হয়ে উঠে। প্রথমে এ কম্পন ম্যালিয়াস অস্থিকে সক্রিয় করে তোলে এবং এখান থেকে উদ্দিপনা ইনকাস অস্থিতে পৌছে। তারপর ইনকাস থেকে উদ্দিপনা স্টেপিস অস্থিতে পৌঁছে। স্টেপিস অস্থি সক্রিয় হয়ে উঠলে তার সাথে সংযুক্ত থাকা ওভাল উইন্ডো নাড়াচাড়া শুরু করে এবং রাউন্ড উইন্ডো স্ফীত হয়। অর্থাৎ উদ্দিপনা অস্থিশৃঙ্খল থেকে ওভাল উইন্ডোর মাধ্যমে ককলিয়ায় প্রবেশ করে। উক্ত উদ্দিপনা ককলিয়ার জলীয় পদার্থে সঞ্চালিত হয়। যখন এই উদ্দিপনা ভেস্টিবুলার জলনালি অতিক্রম করে টিমপ্যানিক জলনালিতে নেমে আসে তখন বেসিলার মেমব্রেনে উত্তেজনা দেখা দেয়। বেসিলার মেমব্রেনের এই উত্তেজনার ফলে অর্গান অব কর্টির হেয়ার সেলগুলোর সাথে সংযুক্ত স্নায়ুতন্তুসমূহ উদ্দিপিত হয়ে উঠে। সেই স্নায়ুবিক উত্তেজনা ককলিয়ার সাথে সংযুক্ত শ্রবণ স্নায়ু/অডিটির নার্ভের সাহায্যে মস্তিষ্কে চলে যায়। ফলে আমরা শুনতে পাই।

 


৩টি মন্তব্য:

RBFried থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.